চীনের ৭৬তম জাতীয় দিবস উদযাপন: জাতীয় ঐক্য ও গৌরবের দিন
আজ
(বুধবার)উদযাপিত হলো
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৬তম জাতীয়
দিবস। যথাযথ আয়োজন
ও উৎসবমুখর পরিবেশে চীনসহ
বিশ্বব্যাপী দিনটি উদযাপিত হয়েছে
। ১৯৪৯
সালের ১ অক্টোবর মহান
নেতা মাও সে-তুং
রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন
স্কয়ারে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন
প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।
সেই থেকে প্রতিবছর দিনটি
জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত
হয়ে আসছে। এই দিনটি চীনের
ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচনা
করে, যা শুধু রাজনৈতিক
স্বাধীনতাই নয়, বরং চীনা
জনগণের আত্মমর্যাদা, ঐক্য
ও উন্নয়নের প্রতীক হয়ে
ওঠে। চীনের জনগণ
এই দিনটিকে দেশপ্রেম
ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে
স্মরণ করে।
জাতীয়
দিবসের ভোরে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন
স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয়
ঐতিহাসিক পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান। ভোর থেকেই হাজার
হাজার মানুষ সেখানে জড়ো
হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের
মুহূর্তের সাক্ষী হয়। জাতীয় সঙ্গীতের সুরে
উড়তে থাকে লাল পাঁচ
তারকা খচিত পতাকা।
তখন পুরো পরিবেশ দেশপ্রেমের
আবহে ভরে ওঠে।
শিশু, কিশোর, তরুণ
থেকে শুরু করে প্রবীণ
নাগরিকরা সবাই একসাথে দেশের
প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ
করেন।
পাশাপাশি
রাজধানী বেইজিংসহ দেশজুড়ে
অনুষ্ঠিত হয় কুচকাওয়াজ, সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান, আলোকসজ্জা ও
আতশবাজির প্রদর্শনী।
শহর, নগর ও গ্রামে
সাজানো হয় চীনের জাতীয়
পতাকা, রঙিন ব্যানার, পোস্টার
ও রঙ্গিন সাজে।
জনসমাগমে মুখর হয়ে ওঠে
পর্যটন কেন্দ্রগুলো।
শিল্পীদের পরিবেশনায় উঠে
আসে চীনের সমৃদ্ধ ইতিহাস,
সংস্কৃতি ও আধুনিক উন্নয়নের
নানা দিক। হংকং
ও ম্যাকাও বিশেষ প্রশাসনিক
অঞ্চলেও জাতীয় দিবস উপলক্ষে
আয়োজিত হয় পতাকা উত্তোলন,
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও
নানা কর্মসূচি।
জাতীয়
দিবসের আগের দিন বেইজিংয়ের
গণ-মহাভবনে আয়োজিত
হয় অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান। এতে উপস্থিত ছিলেন
রাষ্ট্রপতি ও চীনা কমিউনিস্ট
পার্টির সাধারণ সম্পাদক
সি চিন পিংসহ শীর্ষ
নেতৃবৃন্দ এবং দেশি-বিদেশি
প্রায় ৮০০ অতিথি।
প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং অনুষ্ঠানটি
সঞ্চালনা করেন।
গুরুত্বপূর্ণ
ভাষণে সি চিন পিং
বলেন, “চীনা জাতির মহাজাগরণ
এক অভূতপূর্ব যাত্রা। এই যাত্রায় আমাদের
ঐক্য, অধ্যবসায় ও
দৃঢ় সংকল্পই আমাদের
শক্তি।” তিনি দেশকে
আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার
অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন
এবং বলেন, ৭৬
বছরের অর্জন এসেছে জনগণের
আত্মত্যাগ ও নিরলস প্রচেষ্টার
মাধ্যমে। তিনি প্রতিশ্রুতি
দেন, নতুন যুগের চীন
আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তি-নবায়নের
মাধ্যমে বৈশ্বিক উন্নয়নে
আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখবে।
তিনি আরও বলেন, হংকং ও ম্যাকাওয়ের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা, তাইওয়ানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের অংশ। পাশাপাশি বৈশ্বিক শান্তি ও উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোরও আহ্বান জানান তিনি।
১৯৪৯
সালের আগে চীন দীর্ঘ
অস্থিরতা ও বিদেশি আগ্রাসনের
শিকার ছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে
সেই অন্ধকার অধ্যায়ের
অবসান ঘটে। জাতীয়
দিবস তাই শুধু একটি
রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান নয়,
বরং চীনা জনগণের মুক্তি,
আত্মবিশ্বাস ও উন্নয়নের প্রতীক। দিনটি চীনা নাগরিকদের
জন্য আত্মমর্যাদা ও
গর্বের উৎস। আধুনিক
চীনের শিল্পায়ন, প্রযুক্তি,
শিক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন
সবই এ দিবসের প্রেরণা
থেকে উৎসারিত।
জাতীয়
দিবস উপলক্ষে শুধু
চীনের ভেতরেই নয়,
বিদেশের বিভিন্ন শহরেও
চীনা দূতাবাস ও
প্রবাসী চীনারা বিশেষ
অনুষ্ঠান আয়োজন করেন।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, প্রদর্শনী,
সেমিনার ও মিলনমেলায় বিশ্বের
বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে
থাকা চীনারা দেশের
প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ
করেন।
হংকং
ও ম্যাকাও বিশেষ প্রশাসনিক
অঞ্চলে জাতীয় দিবস উদযাপন
অত্যন্ত উৎসবমুখরভাবে হয়েছে। হংকংয়ে গোল্ডেন বউহিনিয়া
স্কোয়ারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন
হংকং এসএআর-এর
প্রধান জন লি, কেন্দ্রীয়
সরকারের প্রতিনিধি এবং
সমাজের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। সকাল ৮টায় হংকং
পুলিশ জাতীয় সঙ্গীত ‘মার্চ
অফ দ্য ভলান্টিয়ারস’ বাজিয়ে
পতাকা উত্তোলন শুরু
করে। জাতীয় পতাকা
ও হংকংয়ের পতাকা ধীরে
ধীরে উত্তোলিত হয়,
অতিথিরা সম্মান প্রদর্শন
করেন এবং জাতীয় সঙ্গীত
গাইতে থাকেন। সরকারের
ফ্লাইং সার্ভিসের হেলিকপ্টার
ও ফায়ার সার্ভিসের জাহাজে
জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করা
হয়, যা আয়োজনে এক
ভিন্ন রঙ যোগ করে।
ম্যাকাওয়েও
একইভাবে রাষ্ট্রপতি ও
স্থানীয় প্রশাসনের আয়োজনে
অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত
হয়। ম্যাকাওয়ের প্রধান
নির্বাহী হো ইয়াত সেং
বলেন, “জাতির সমৃদ্ধি ও
শক্তি আমাদের উন্নয়ন
ও অগ্রগতির জন্য শক্ত
ভিত্তি তৈরি করেছে।
আমরা দেশের অগ্রগতির সঙ্গে
সামঞ্জস্য রেখে ‘এক
দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতিকে
আরও শক্তিশালী করব।”
চীনের
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতীয়
দিবস উপলক্ষে স্বল্পদৈর্ঘ্য
চলচ্চিত্র “দ্য রাইট পাথ”
প্রকাশ করেছে। এতে
অতীত ও বর্তমান দৃশ্য
মিলিয়ে চীনের অসাধারণ উন্নয়নের
গল্প তুলে ধরা হয়েছে।
জাতীয় দিবস উপলক্ষে পরিবহন ও পর্যটন খাত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। শহরের পার্ক, ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ঢল নামে। পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। চীনের জাতীয় দিবসের ছুটিতে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যটন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে দেশজুড়ে মানুষ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে এবং অবকাশযাত্রার জন্য গণপরিবহনে ভ্রমণ করে থাকে। পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই ছুটিতে বিভিন্ন যানবাহনে যাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৩৬ কোটি ছাড়াবে, যা গড়ে দৈনিক ২৯ কোটি ৫০ লাখ। এটি গত বছরের তুলনায় ৩.২ শতাংশ বেশি। বিশেষ করে মধ্যম ও দীর্ঘ দূরত্বের ভ্রমণ এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে, যেখানে অনুমান করা হচ্ছে মোট ভ্রমণের প্রায় ৮০ শতাংশ নিজস্ব গাড়িতে সম্পন্ন হবে। রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই ৮ দিনব্যাপী ছুটিতে প্রায় ২১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করবেন, আর বেসামরিক বিমান চলাচল প্রশাসন জানায়, বিমানে ১ কোটি ৯২ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করবেন (তথ্য সূত্র: সি আর আই)। এছাড়া, আন্তর্জাতিক পর্যটক প্রবাহও বৃদ্ধি পাবে; শাংহাই, কুয়াংচৌ এবং ম্যাকাওর বড় বিমানবন্দর গুলোতে প্রতিদিন লাখের বেশি মানুষ যাতায়াত করবে। ফলে জাতীয় দিবসের ছুটি চীনের অভ্যন্তরীণ পর্যটন, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ এবং অর্থনীতির সক্রিয়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জাতীয়
দিবস উদযাপনের মধ্য
দিয়ে চীনা জনগণ তাদের
ঐক্য, দেশপ্রেম ও
গৌরবের বার্তা পুনরায়
স্বীকৃতি দেয়। এটি
শুধু এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান
নয়, বরং দেশীয় সংস্কৃতি,
ঐতিহ্য ও আধুনিকায়নের সঙ্গে
সমন্বয় রূপে চীনের মানুষের
উন্নতির গল্পও তুলে ধরে।
Arif/Raoha
BCYSA.ORG এর নিউজ-এ আপনিও লিখতে পারেন। গণচীনে প্রবাস জীবনে আপনার অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খবরাখবর, আনন্দ-বেদনার গল্প, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ, অনুভূতি, বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর ছবিসহ আমাদের (বাংলা অথবা ইংরেজিতে) পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ইমেইল : [email protected]।